রাজশাহী প্রতিনিধি:
রাজশাহীতে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ও বৃহত্তম ‘ওয়ানগালা’ ও ‘লবান’ (নবান্ন) উৎসব। গারো, শাঁওতাল, পাহাড়ি, মাহালি ও ওঁরাও—এই পাঁচ আদিবাসী সম্প্রদায় প্রতিবছর শস্য দেবতা ‘মিসি সালজং’-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এবং নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতি চেয়ে এ উৎসব পালন করে আসছে।
শনিবার (৮ নভেম্বর) সকাল ১০টায় নগরীর বাগানপাড়ায় অবস্থিত উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রাল গির্জা প্রাঙ্গণে দেবতাদের পূজার মধ্য দিয়ে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ধর্মীয় আচার ‘আমুয়া’ ও ‘রুগালা’ পালনের পর শুরু হয় বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
গারো শিল্পীরা নিজস্ব ভাষায় ঐতিহ্যবাহী গান পরিবেশন করেন, যা উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। বিশেষ আকর্ষণ ছিল গারোদের ঐতিহ্যবাহী ‘জুম নাচ’। ঢাক-ঢোলের তালে তালে নাচে অংশ নেন নারী-পুরুষ-শিশুরা—তাতে পুরো প্রাঙ্গণ পরিণত হয় আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভরপুর এক মিলনমেলায়।
উৎসবের আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের ডিডি বিশপ জের্ভাস রোজারিও বলেন,
“বাংলাদেশ বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যময় অসাম্প্রদায়িক দেশ। ওয়ানগালা ও লবান উৎসব সেই বৈচিত্র্য ও সম্প্রীতিরই প্রতীক। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এ ঐতিহ্য সংরক্ষণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।”
কারিতাস বাংলাদেশের আঞ্চলিক পরিচালক ড. আরোক টপ্য বলেন,
“ওয়ানগালা ও লবান শুধুই ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি আদিবাসী সংস্কৃতি ও পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই উৎসব তাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি সমাজে ঐক্য ও পারস্পরিক বন্ধনকে মজবুত করে।”
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের ভিকার জেনারেল ফাদার ফাবিয়ান মারান্ডা, রাজশাহী নানকিং গ্রুপের প্রোপাইটর এহসানুল হুদা, রাজশাহী পার্লার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রুকসানা হুদা এবং উত্তম মেষপালক ক্যাথিড্রাল গির্জার পালকীয় পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফ্রান্সিস সরেন। তারা সবাই গারো ও অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি রক্ষায় সমাজের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
নকমা (গ্রামপ্রধান) লোটাস চিসিম বলেন,
“ওয়ানগালা ও লবান উৎসব আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার প্রতীক। আমরা চাই, ভবিষ্যৎ প্রজন্মও যেন এই সংস্কৃতির মর্ম অনুধাবন করে এবং গর্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যায়।”
উৎসব উপলক্ষে গির্জা প্রাঙ্গণে বসেছিল ঐতিহ্যবাহী খাবারের মেলা। জুমের আলু, কুমড়া, শামুক, কাঁকড়া ও পাহাড়ি ফলমূলসহ নানা খাবার ছিল দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
ওয়ানগালা ও লবান উৎসব আদিবাসীদের সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করার পাশাপাশি জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা দেয়। রাজশাহীর এই উৎসব এখন শুধু আদিবাসীদের নয়, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে উঠেছে।